জাহাঙ্গীর আলম অর্ণব
(প্রথম পর্ব)
ধূষর শুভ্র নীল আকাশটার যেন আজ মন ভালো নেই। তাই বিকাল থেকে নীল আকাশ টা তার মনের ক্যানভাসে ভাসিয়েছে হালকা মেঘের ভাসমান তরী। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ পর রিমঝিম বৃষ্টি শুরু হবে। এসব কথা ভাপতে ভাপতেই সুমন ঘুমিয়ে পড়লো। শরীর টা আজ বেশি ভাল না সুমনের, শরীরে হালকা জ্বর বইছে,সুমন ঘুমের ঘরে বিড়বিড় করে কি যেন বলে চলেছে। এদিকে মেঘাছন্ন আকাশটা তার মনের ক্যানভাসে জমে থাকা কষ্টগুলো কে রিমঝিম বৃষ্টি তে পরিণত করেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি শেষে সন্ধ্যার ঘনঘাটা পেরিয়ে প্রকৃতি যেন সাজিয়েছে তার নতুন সাঁজ। সুমনের আম্মু সুমন কে ডাকতে শুরু করেছে…..(দরজার ওপাশ থেকে)
আম্মু : সুমন,সুমন ওঠ বাবা,ওঠ ,তোর দাদির জন্য বাজার থেকে ঔষধ টা নিয়ে আসতো বাবা । সুমন ..সুমন…. সুমনের কোনে সাড়া শব্দ না পাওয়াই,সুমনের আম্মু রুমে প্রবেশ করলো সুমনের গায়ে হাত রাখতেই বললো, একি এত অনেক জ্বর, কপালে ও হাত দিলো । মা এর মন ছটফট করতে শুরু করলো। মা দেরি না করে দ্রুত ডাক্তার কে ফোন দিলেন। আর সুমনের মাথায় জল পট্টি দিতে থাকলো। প্রায় ১৫ মিনিট পর ডাক্তার আসলো।জ্বর পরীক্ষা করে সুমনের ঔষধ দিলো। মা খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। সুমন তার একমাত্র ছেলে। সুমনের ছোট্ট একটা বোন ছিল ,দুই বছর বয়সে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাই, সুমনের বাবা ও বেচে নাই । তারপর সুমন কে নিয়েই বেচে আছে। অনেক স্বপ্ন ছেলে কে নিয়ে, ছেলে একদিন বড় হবে ,মা এর দুঃখ ঘুচাবে। সুমন কে ওষুধ খাইয়ে মা নামাজের পাটিতে ছেলের সুস্থতা প্রার্থনা করতে লাগলেন। একটু একটু করে সুমন সুস্থ হয়ে উঠলো। কিন্তু সুমন এক ডিপ্রেশন এ ভুগছে কিছুদিন। যা মা কে বলতে পারছে না। সুমনের সামনে এইচ-এস-সি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ এর টাকা লাগবে। কীভাবে ম্যানেজ হবে এত টাকা এটাই নিয়ে টেনশন। দুই মাস হলো টিউশনি ও নাই। সুমন ভাবতে থাকে দুই একটা টিউশনি হলে হয়ত টাকা টা ম্যানেজ হতো। হঠাৎ সুমনের ফোন টা বেজে উঠলো।
হ্যালো
——আসসালামু আলাইকুম
——ওয়ালাইকুম আসসালাম(ওপাশ থেকে)
——কে বলছেন…?
——আচ্ছা এটা কি সুমনের নাম্বার?
—–জি বলুন আমি সুমন
—–আসলে আমি আমার মেয়েটা কে পড়াতে চাইছিলাম,আপনার কি সময় হবে??
কিছু চিন্তা না করেই সুমন বললো জি আঙ্কেল আমি পড়াবে। অতঃপর কিছুক্ষণ কথোপকথন চললো। এরই মধ্যে সুমন ঠিকানা টা নিয়ে নিলো(এতক্ষণ যার সাথে কথা হচ্ছিলে সে হল রুপার বাবা।তিনি একজন দিনমজুরি রিকশাচালক।)
আগামী বুধবার সুমন ঠিকানা অনুযায়ী বাসায় চলে গেল। বাসায় গিয়ে দেখলে খড়ের একটা চৌচালা। রুম একটা। চালের এক পাশ থেকে কিছুটা ধসে ও পড়েছে।
সুমন বাইরে থেকে ডাক দিলো,বাড়িতে কেউ আছেন ? ঘর থেকে রুপার আম্মু বেরিয়ে এলো।
সুমন: আসসালামু আলাইকুম আন্টি
আন্টি: ওয়ালাইকুম আসসালাম।
আসো বাবা আসো। তোমার আঙ্কেল আমাকে ফোনে সব বলেছে । কথাটা শেষ না হতেই রুম থেকে রুপা বেরিয়ে এলো। রুপা কে কাছে টেনে বললো,এই যে আমার মেয়ে ক্লাস তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। একেই পড়াতে হবে।।
সুমন: আচ্ছা আন্টি
আন্টি: তো বাবা তোমাকে কত টাকা দিতে হবে পড়ানোর জন্য?
সুমন কি বলবে বুঝতে পারছে না।শুধু নির্বাক হয়ে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আন্টির কথায় চমকে সুমনের টনক নড়লো।
সুমন: আন্টি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আপনার খুশি। যেটা মন চাই ওটাই দিয়েন
আন্টি: আমি ৫০০ টাকা দিতে পারবো তোমাকে বাবা।
সুমন: আচ্ছা আনটি (আশ্রু সিক্ত চোখে বললো)
সুমন আচ্ছা আন্টি আমি আগামীকাল থেকে পড়াতে আসবো।
আন্টি: আচ্ছা বাবা।
সুমন রুপার বাসা থেকে নিজ বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলো।আর ভাপতে লাগলো এত কম টাকায় কীভাবে আমার খরজ মিটবে। আমি তো মনে করে ছিলাম একটা স্টুডেন্ট, বাসায় পড়াতে যাওয়া হয়ত একটু বেশিই দিবে। কিন্তুএটা কি হলো(হাঁটছে আর ভাপছে) অতঃপর এসব কথা ভাপতে ভাপতেই বাসায় পৌঁছালো। ক্লান্তি মাখা চেহারা নিয়ে রুমে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ সুমনের আম্মু এসে সুমন কে দেখে বললো।
—–কি রে বাবা
—–কখন আসলি?
—–এইতো আম্মু এখন
—–তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন,কি হয়েছে ??
—–কই কিছু হয়নি আম্মু
—–আজ না কোথায় টিউশনির জন্য গিয়েছিলি সেটা কি হলো ? হ্যাঁ আম্মু টিউশনি টা করবো আমি।
সুমন: কিন্তু…….
আম্মু :কিন্তু কি বাবা?
সুমন: আম্মু টাকা কম দিবে…
আম্মু: তাহলে??
সুমন: তারপর ও পড়াবো আম্মু।একটা কারণে পড়াবো আম্মু
আম্মু:কি কারণ?
সুমন: আম্মু আমার স্টুডেন্টের নাম রুপা।জানো আম্মু রুপার দিকে যখন তাকিয়েছিলাম তখন সুমাইয়ার কথা খুব মনে পড়ছিলো।আমার ছোট্ট বোনটা যদি আজ বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়ত ও ও আজ রুপার মতো হতো।কি মায়াভরা মিষ্টি মুখ রুপার, যেন ঠিক আমার বোনের মতো। বনটা আমাদের ছেড়ে চলে গেল ও কেন আম্মু,কেন চলে গেল?? কথা গুলা বলতে বলতে সুমন কেঁদে ফেললো সাথে সুমনের আম্মু ও। নিজেকে সামলিয়ে বললো বাবা কাদিস না।তুই আছিস, ,এখন তোকে নিয়েই আমি বেঁচে আছি। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সুমনের আম্মু বললো আচ্ছা বাবা যা হাতমুখ ধুয়ে আয়, পিঠে বানিয়েছি খাবি আয়।
সুমন : আচ্ছা আম্মু(অশ্রু সিক্ত কণ্ঠে বললো)
আজ রবিবার আজ থেকে রুপাকে পড়াবে সুমন, এই উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সুমন যখন রুপাদের বাসায় পৌঁছে রুপা কে ডাক দিলো। রুম থেকে বেরিয়ে আসলো রুপা। রুপা: আসসালামু-অলাইকুম স্যার সুমন: অলাইকুম-আসসালাম,কেমন আছো রুপা? রুপা: ভালো আছি স্যার,এটা বলেই স্যার কে রুমে নিয়ে গেল। বই নিয়ে পড়তে বসলো।
সুমন: রুপা..
রুপা: জি স্যার,
সুমন: রুপা তুমি আমাকে স্যার বলবে না ভাইয়া বলবে কেমন
রুপা: কিন্তু কেন স্যার?
সুমন: আমি বলতে বলছি তাই।
রুপা: আচ্ছা স্যার
সুমন: আবার স্যার
রুপা: আচ্ছা ভাইয়া।
সুমন মিষ্টি হাসি নিয়ে বললো এইতো আমার লক্ষ্মী বোন। হুম এবার বই বের করো। রুপা বই বের করলো। কবিতার বই। সুমন বই থেকে একটা কবিতা আবৃতি করতে বললো। রুপা খুব সুন্দর করে আবৃতি করলো। সুমন আবৃতি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। বুঝতে পারলো রুপা ট্যালেন্ট। যদি একটু ভাল করে পড়ায় আর যদি নিজেও ভাল করে বাসায় মন দিয়ে পড়ে তাহলে একদিন সে খুবই ভালো রেজাল্ট করবে। এই স্বপ্ন টা নিয়েই সুমন রুপা কে পড়াতে লাগলো।রুপা ও মন দিয়ে পড়তো। প্রতি পরীক্ষাতে রুপা ভালো রেজাল্ট করলো।রুপার এই উন্নতি দেখে রুপার মা -বাবা খুব খুশি হলো। রুপাকে পড়াতে পড়াতে সুমন আর ও দুই টা টিউশনি পেয়েছে। সুমনের ফরম ফিলাপ এর টাকার দুশ্চিন্তা টা রইলো না। নিজের লেখাপড়া আর টিউশনির ব্যস্ততার প্রহর নিয়েই সুমন এখন ভালোই আছে।