অনলাইন ডেস্ক
সারা দেশে বিদ্যুৎ সংকটে ত্রাহি অবস্থা মানুষের। বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ বারবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। এর মধ্যেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে লাগানো হচ্ছে ৩২০টির বেশি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি)।
জানা গেছে, গাজীপুরের বোর্ডবাজারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ চলমান। মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবে সেখানে নির্মাণ হচ্ছে ১০ তলা ডরমিটরি ভবন। ভবনটিতে প্রয়োজন না থাকলেও সব মিলিয়ে ৩২০টির বেশি (সাড়ে পাঁচশ টন) এসি লাগানো হচ্ছে। ভবনের প্রতিটি কক্ষেই লাগানো হচ্ছে এসব এসি। এ ছাড়া সাড়ে ৬ শতাধিকের বেশি সিলিং ফ্যান লাগানোর প্রক্রিয়া চলমান। এদিকে ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার অনেক আগেই কেনা হয়েছে আসবাব। এখন সেগুলো নষ্ট হচ্ছে ধুলা-ময়লা পড়ে। এসব আসবাব কেনাকাটাতেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নিতে মূল ক্যাম্পাসে আসেন। প্রশিক্ষণকালীন তাদের থাকার জন্য আরেকটি ডরমিটরি ভবন থাকলেও নতুন করে এ ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। অন ক্যাম্পাস অনার্স কোর্সে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য পুরোনো ডরমিটরি ভবন ছেড়ে দিয়ে নতুন ভবনে শিক্ষকদের রাখার পরিকল্পনা করেছিল প্রশাসন। অথচ, অন ক্যাম্পাস অনার্স কোর্সের শুরু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নিষেধাজ্ঞা ছিল।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আড়াইশ কোটি টাকার মাস্টারপ্ল্যানে যে কয়টি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, এর মধ্যে ডরমিটরি ভবন একটি। সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, ১০ তলা ভবনটির নিচতলায় একটি বলরুম ও একটি বড় কক্ষ রয়েছে। এর ওপরে দ্বিতীয় থেকে দশম তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরে ৩১টি করে মোট কক্ষ রয়েছে ২৭৯টি। গত এক মাসে দুদফা ভবনটি পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ডরমিটরি ভবনের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। শ্রমিকরা এখন টাইলস, কাঠের ফ্রেম লাগানোর মতো টুকিটাকি কাজ করছেন। বেশিরভাগ কক্ষে এসি ও ফ্যান লাগানোর কাজ শেষ।
নিচতলার বড় কক্ষটিতে ৩ টনের এসি লাগানো হয়েছে ২৩টি। এসিগুলোর পাশ দিয়ে লাগানো হয়েছে সিলিং ফ্যানও। এই এক কক্ষেই ফ্যান রয়েছে ২৭টি। পাশের বলরুমে সিলিং ফ্যান না থাকলেও ৩ টনের ২১টি এসি লাগানো হয়েছে।
দ্বিতীয় থেকে দশম তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরে থাকা ৩১ কক্ষের প্রতিটিতে একটি করে ফ্যানই যথেষ্ট ছিল। সেখানে ফ্যান লাগানো হচ্ছে দুটি করে, সঙ্গে আছে একটি করে দেড় টনের এসি। এ ছাড়া প্রতি ফ্লোরে লিফটের সামনে আছে আরও ৮টি ফ্যান। কোনায় কোনায় আছে আরও কিছু ফ্যান।
আরও দেখা গেছে, ভবনের নিচতলার বড় কক্ষটিতে সারি সারি চেয়ার-টেবিল খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার অনেক আগেই এগুলো কেনা হয়েছে। কেনার পর এগুলো এভাবেই উন্মুক্ত ফেলে রাখা হয়েছে। সেখানে পড়েছে ধুলার স্তর। ধুলা পড়ে নষ্ট হতে চললেও এগুলো সংরক্ষণে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এ ছাড়া ভবনটিতে নিম্নমানের টাইলস, সিলিং ও বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করার অভিযোগও রয়েছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আসবাব কিনে সেগুলো খোলা অবস্থায় ফেলে রেখেছে। এগুলো আগেভাগে কেনা হয়েছে অর্থ আত্মসাতের জন্য। এখন সেগুলো নষ্ট হচ্ছে। আবার নিম্নমানের টাইলস কেনা হয়েছে। এখানে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার হয়েছে। রেলিংয়ে ব্যবহৃত স্টিল নিম্নমানের, সে কারণে এরই মধ্যে অনেক জায়গায় মরিচা ধরেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, পুরোনো ডরমিটরি ভবনেই শিক্ষকদের জায়গা হয়ে যেত। শুধু অর্থ আত্মসাতের জন্য নতুন ডরমিটরি ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ফাইভ স্টার মানের দেখাতে সেখানে এসি লাগানো হচ্ছে। হরিলুটের জন্যই এটি করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সাবেক উপাচার্য মশিউর রহমান, সাবেক উপ-উপাচার্য মূনাজ আহমেদ নুরসহ মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে তিনি ছিলেন। অথচ এখনো তিনি প্রশাসনে সুবিধাজনক জায়গায় আছেন। তাই ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীকে ধরলেই দুর্নীতির নাড়ি-নক্ষত্র বের হবে।
ভবনের আসবাব কেনাকাটার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড স্টোর দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক পারভেজ সাজ্জাদ বলেন, আমি সদ্য যোগ দিয়েছি। আগের পরিচালক এ বিষয়ে বলতে পারবেন। একই দপ্তরের সাবেক পরিচালক আবু হানিফ বলেন, মূলত এসব কেনাকাটা করে প্রকৌশল শাখা। প্রকৌশল দপ্তর থেকে আমাকে প্রকিউরমেন্ট দপ্তরে পাঠানো হলে টেন্ডারগুলো হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।
প্রধান প্রকৌশলী মিজানুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আমাদেরও অনেক সময় কিছু করার থাকে না। কনসালট্যান্ট ড্রয়িং, ডিজাইন করে দিয়েছিল। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও করা হয়েছিল। তারা ভালো বলতে পারবেন। প্রকল্পের সঙ্গে থাকা বা সবকিছু জানা মানেই এই না যে, তিনি সবকিছু করতে পারবেন। ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারসহ বিশেষজ্ঞ কমিটি যেভাবে চেয়েছে, সবকিছু সেভাবে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মশিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, পুরো কাজে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী যুক্ত ছিলেন। তিনি এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে হারুন স্যারের (বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ) সময়ে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ শুরু হয়। আমার সময়ে প্রো-ভিসি নিজাম স্যার (সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিজামউদ্দিন আহমেদ) এসির সংখ্যা কমিয়ে পারচেজ করেছিলেন। সেখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।
তিনি আরও বলেন, পুরোনো ডরমিটরি নির্মাণে মান খারাপের অভিযোগ ছিল। সে কারণে নতুন ডরমিটরি ফাইভ স্টার মানের করার কথা ছিল। অন ক্যাম্পাসের একটি বিষয় ছিল ট্যুরিজম, এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা যাতে ডরমিটরিকে আদর্শ ল্যাবের মতো ব্যবহার করে, একটি ফাইভ স্টার মানের হোটেল কেমন হয়, তার ধারণা নিতে এই ডরমিটরি নির্মাণ করা হচ্ছে। আর পুরোনোটিতে অন ক্যাম্পাস অনার্স কোর্সের শিক্ষার্থীদের রাখার পরিকল্পনা ছিল।
আসবাব ফেলে রেখে নষ্ট করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে অধ্যাপক মশিউর বলেন, আসবাব যে সময়ে যা আসার দরকার ছিল, তাই এসেছে। কিন্তু সঠিক সময়ে ব্যবহার হচ্ছে না। এতদিনে ঠিকাদারদের উচিত ছিল কাজ বুঝিয়ে দেওয়া।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য ড. এ এস এম আমানুল্লাহর মোবাইলে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।