মো. রুহেল আহম্মেদ, স্টাফ রিপোর্টার
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার পৌরসভার অন্তর্গত দক্ষিণ চকযদু (মাহালী পাড়া) গ্রামের বাঁশ শিল্পের কারিগরদের জীবন যেন এক অবিরাম সংগ্রামের গল্প।
বাঁশ শিল্প বাঙালির সংস্কৃতির একটি বড় অংশ। বাঁশ দিয়ে ঘরের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। আর এসব জিনিসপত্রের কদরও ছিল ভালো। কিন্তু বর্তমান বাজারে আধুনিক প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতা, অপ্রতুলতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প।
ধামইরহাট নামটির উৎপত্তি হয়েছে বাঁশের তৈরি একটি ঐতিহ্যবাহী পণ্য “ধামা” থেকে। “ধামা” একসময় এ অঞ্চলে শস্য মাপা এবং সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হতো। স্থানীয় ইতিহাসবিদদের মতে, ধামইরহাট এলাকায় বাঁশের তৈরি পণ্যের ব্যাপক উৎপাদন ও ব্যবহার ছিল, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।
“ধামা” শব্দটি উচ্চারণের তারতম্য এবং ভাষার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ধামইরহাট নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। একসময় এই অঞ্চলের সাপ্তাহিক হাটে ধামাসহ নানা বাঁশজাত পণ্যের ব্যাপক বেচাকেনা হতো। ধামইরহাটের “ধামা” কেবল স্থানীয় ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আশপাশের জেলাগুলোর কৃষকরাও এটি ব্যবহার করতো।
কালের বিবর্তনে, আধুনিক প্রযুক্তি ও প্লাস্টিকের সহজলভ্যতার ফলে বাঁশজাত পণ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। সেইসঙ্গে “ধামা”র ঐতিহাসিক মূল্যবোধও আজ বিলুপ্তির পথে।
মাহালী পাড়ার বেশিরভাগ মানুষই বাঁশজাত পণ্য তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
যুগ যুগ ধরে বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রেখে ঐতিহ্যবাহী বাঁশজাত পণ্য তৈরি করে আসছেন।এখানে বসবাসরত মাহালী সম্প্রদায়ের পরিবারের প্রতিটি সদস্য –স্বামী, স্ত্রী এবং সন্তানরাও—এই কাজে যুক্ত। তারা বাঁশ কাটার কাজ থেকে শুরু করে পণ্য তৈরির প্রতিটি ধাপে অংশ নেন।
স্থানীয় কারিগর “বেনচেনসা হেমরম” বলেন, আমাদের নিজস্ব বাঁশ নেই! বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০০ থেকে ২০০ টাকায় বাঁশ কিনে আনতে হয়। পরিবহন খরচ এর কারনে বাঁশজাত পণ্যের খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। অথচ মহাজনদের কাছে পাইকারি দামে বিক্রি করায়, লাভ বলতে কিছুই থাকে না।
তিনি এও বলেন, “সংসার চালানোর জন্য সন্তানদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে দিনরাত পরিশ্রম করি। কিন্তু লাভ এতই কম যে, ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা তো দূরের কথা, লোন পরিশোধ করাও কঠিন।”
আরেক কারিগর “আন্তনি বাস্কে” বলেন, “আমরা বাপ-দাদার শেখানো কৌশল ধরে রেখেছি। কুলা, ডালা, ঝাড়ু, খৈ চালা, গরুর গোমাই, টোপা, ধামা, মাছ ধরার খলসানি এবং চাটাই সহ নানা পণ্য তৈরি করি। কিন্তু এগুলোর চাহিদা কমে যাওয়ায় আয়ও অনেক কমে গেছে।
মাতিয়াস মার্ডি আরও বলেন, “আমাদের পণ্য পাইকারি দামে বিক্রি করতে হয়। ফলে প্রকৃত মূল্য পাই না। সরকার থেকে যদি সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেতাম, তাহলে হয়তো আমাদের জীবন একটু ভালো হতে পারত।
বাঁশজাত পণ্যের প্রতি মানুষের চাহিদা কমে যাওয়ার পেছনে প্লাস্টিকের সস্তা পণ্য এবং আধুনিক জীবনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। নতুন প্রজন্ম আর এই পেশায় আসতে চায় না। তারা মনে করে, এ কাজের আর্থিক নিরাপত্তা নেই।
এ ছাড়া, বাজারজাতকরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কারিগরদের আয় আরও কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে মাহালী পাড়ার বেশিরভাগ পরিবার দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত।
মাহালী পাড়ার কারিগররা মনে করেন, সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঠিক সহযোগিতা পেলে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। তাদের সুলভ মূল্যে বাঁশ সরবরাহ, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, উন্নত বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা, স্বল্প সুদের ঋণ প্রদান, এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের দাবি রয়েছে।
এ ছাড়া, স্থানীয় পর্যায়ে কুটির শিল্প মেলার আয়োজন করলে তাদের পণ্য সরাসরি গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। এ ধরনের উদ্যোগে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমে যাবে এবং কারিগররা ন্যায্য মূল্য পাবেন।
ধামইরহাটের বাঁশশিল্প কেবল কিছু মানুষের জীবিকা নয়, এটি একটি গৌরবময় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অংশ। “ধামা”র ঐতিহাসিক গুরুত্ব ধামইরহাটের পরিচয়কে সমৃদ্ধ করেছে। সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে এই ঐতিহ্য কেবল ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকবে।
সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, এনজিও এবং জনগণের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। “ধামা”র ঐতিহ্য রক্ষা শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকেই মজবুত করবে না, বরং পরবর্তী প্রজন্মকে একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের অংশীদার করে তুলবে ।