ইঞ্জিনিয়ার শোয়েব হোসেন শিক্ষক, শিল্পী, মানবাধিকার কর্মী
এমপি বলতে আমরা বুঝি মেম্বার অব পার্লামেন্ট; বাংলায় সংসদ সদস্য।যার মূল কাজ আইন প্রণয়ন করা। সুতরাং আইনকানুন বোঝেন বা বোঝার মতো জ্ঞান ও শিক্ষা আছে এমন ব্যক্তিরাই এমপি হবেন এটিই যুক্তিযুক্ত।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সাংবাদিক সংস্থা’র বিশ্লেষণ ও গবেষণায় দেখা গেছে, বাস্তবতার আলোকে বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এমপি হওয়ার জন্য কারো আইন-কানুন বোঝা তো দূরে থাক, পড়ালেখা জানাও নুন্যতম শর্ত নয়। বয়সের সীমারেখা থাকলেও শিক্ষাদীক্ষা একজন নাগরিকের সংসদ সদস্য হওয়ার পথে কোনো নিয়ম বা বাঁধা নয়। সে ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বহুদিন ধরেই একাডেমিক পরিসরে আছে সেটি হলো, পড়ালেখা না জানা মানুষ যখন আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার আসন পেয়ে বসেন। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী আইনের খসড়া (বিল) সংসদে উত্থাপনের পরে স্পিকার যখন সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠান, সেখানে ওই এমপিরা কী ভূমিকা পালন করেন? ওই বিলের ওপরে কমিটির প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপনের পর বিলের ওপরে যে আলোচনা হয় সেখানেই বা তাঁরা কী ভূমিকা রাখতে পারেন? তাঁদের কাজ কি শুধু ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলা! তাও সেটা বুঝে-না বুঝে বা কোন প্রকার পক্ষপাতীত্বতা দেখিয়ে কিংবা শুধুমাত্র দায়িত্ব পালনের খাতিরে!এই কারণেই দেখা যায় আইনের মধ্যে অসম্পূর্ণতা বা ফাঁক-ফোক্কর থেকেই যাচ্ছে।
এটা ঠিক যে, এমপি হওয়ার পর তাঁদের বিভিন্ন ধরনের ওরিয়েন্টেশন হয়। কিন্তু সেসব ওরিয়েন্টেশনের মধ্য দিয়ে একজন এমপি সংবিধান, আইনকানুন, এমনকি সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি (সংসদ পরিচালনার লিখিত নিয়ম) সম্পর্কেই বা কতটুকু জ্ঞান অর্জন করতে পারেন? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এমপিদের ভূমিকা আসলে কতটুকু? ইতিহাস কি বলে?
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তখন সংবিধান প্রণেতারা এমপি হওয়ার শর্তের মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি কেন রাখেননি? কারণ হিসেবে জানা যায়, তখন দেশে শিক্ষার হার ছিল যথেষ্ট কম এবং ওই সময়ে যারা রাজনীতি করতেন, তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতেন। সেখানে তাঁদের ব্যক্তিত্ব, অনুভূতি, ভাবমূর্তি, মানুষের জন্য কাজ করা ও তাঁদের বিপদ-আপদে পাশে থাকার প্রয়াস এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত থাকা। সর্বোপরি সামাজিক ও পারিবারিক পরিচিতি ও অবস্থানই ছিল মুখ্য।
গত অর্ধশতকে দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। প্রান্তিক অবস্থানের অনেকে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং এমপি হওয়ার মতো শিক্ষিত লোক পাওয়া যাচ্ছে না, এমন অযুহাতের সুযোগ নেই। বরং শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত নতুন প্রজন্ম কেন রাজনীতিতে আসছে না বা আসতে পারছে না- সেটি বিরাট বিতর্ক বটেই। সেখানে রাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিচালনায় এবং রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন বড় কারণ বলে মনে করা হয়। আবার এই পদ্ধতি পরিবর্তন তথা দুর্বৃত্তায়ন কমাতে শিক্ষিত মানুষকে রাজনীতিতে আসতে হবে বা আইনপ্রণেতার ভূমিকা পালন করতে হবে। এই যুক্তি বা বাস্তবতাই শিক্ষিত মানুষকে সংসদে নিয়ে আসার প্রথম শর্ত।
এভাবেই হতে পারে সংবিধানের ৬৬তম অনুচ্ছেদের সংশোধন। অর্থাৎ এমপি হওয়ার জন্য একটি নূ্ন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত জুড়ে দেওয়া অতি জরুরি।
যদিও এ পর্যন্ত যতবার সংবিধান সংশোধন হয়েছে কোনোবারই এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এর একটি শক্তিশালী ও যৌক্তিক কারণ হতে পারে এই যে, সংসদ সদস্যরাই এই বিধান যুক্ত করার বিরোধিতা করেন। কারণ ওই সংসদেও এমন অনেক এমপি আছেন, যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা একজন আইনপ্রণেতা হওয়ার জন্য যথেষ্ট না। এখনও যে প্রায় সাড়ে তিনশ এমপি (সংরক্ষিত আসনসহ) আছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন আইনপ্রণেতা হওয়ার মতো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানসম্পন্ন- তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
পরিবর্তনের সূচনা এখনই করা দরকার। উন্নত দেশ তথা অনিয়ম-দুর্নীতি বিহীন দেশের সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো থেকেও আমরা শিক্ষা গ্রহণ বা অনুসরণ করতে পারি। বিষয়টি নিয়ে একাডেমিক পরিসরে তো বটেই, রাজনীতিবিদদের মধ্যে, এমনকি সংসদেও গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত হওয়া জরুরি।
দেশ যেহেতু নানা খাতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং দিনশেষে রাজনীতিবিদরাই দেশ পরিচালনার মূল দায়িত্বটি পালন করেন; বিশেষ করে আইন প্রণয়নের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ্ণ কাজ উপযুক্ত পড়াশোনা না জানা মানুষের পক্ষে সত্যিই কঠিন। সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় না হলেও অন্তত: সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার একটি শর্ত সংবিধানে থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।